হযরত আমির খসরু [ Hazrat Amir Khusro ] উত্তর ভারতের অ্যাটোয়া জেলার মমিনপুর (পাতিয়ালি বা পাতিয়ালা) গ্রামে ১২৫৩ খ্রিষ্টাব্দে (মতান্তরে ১২৩৪, ভিন্নমতে ১২৫৪ খ্রিষ্টাব্দে) জন্মগ্রহণ করেন। এই গ্রামটিকে অনেকে আবার মমিনাবাদ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর পিতা আমির সাইফুদ্দিন মামুদ হাজরা বংশীয় তুর্কি এবং পারস্যের খোরাসান প্রদেশের বলবনের একজন সম্ভ্রান্ত বংশীয় জমিদার ছিলেন।
কথিত আছে, সাইফুদ্দিনের দ্বিতীয় পুত্র খর (মতান্তরে, খুসরু বা খৌসরু) জন্মাবার পর পিতা তাঁকে নিয়ে এক আধ্যাত্মিক ফকিরের কাছে যান। তিনি খসরুকে দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘এই সন্তানের নাম সংগীতের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে।’ মাত্র ১০ বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে শিক্ষাদীক্ষার জন্য হযরত আমির খসরু [ Hazrat Amir Khusro ] মামাবাড়িতে চলে যান। অল্পকালের মধ্যেই তিনি ফারসি, তুর্কি, আরবি, হিন্দি ও ব্রজভাষাসহ নানা বিদ্যায় সুপণ্ডিত হয়ে গুণীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
কালক্রমে হযরত আমির খসরু [ Hazrat Amir Khusro ] দিল্লির অধিপতি গিয়াসউদ্দিন বলবনের আনুকূল্য লাভ করেন। রাজসভায় তিনি আমির খসরু বা সম্ভ্রান্ত রাজবংশীয় বলে পরিচিত হন। সেখানে একদিকে যেমন সংগীত সম্বন্ধে তাঁর আগ্রহ জন্মে, অন্যদিকে রাজনীতি নিয়েও গভীর অধ্যয়নের সুযোগ পান।
এছাড়া বিভিন্ন সাহিত্যিক ও কলাকারদের সংস্পর্শে হযরত আমির খসরু [ Hazrat Amir Khusro ] প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পান। তিনি একাধারে রাজনীতিক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক, কবি এবং উচ্চস্তরের সংগীতশিল্পী হিসেবে পরিচিত হন। এ সময়ে তিনি সুফি নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। আমির খসরুর আধ্যাত্মিক চিন্তাচেতনার উন্নয়নে এবং সুফি মতবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততায় পীর নিজামউদ্দিনের ভূমিকা ও অবদান অপরিসীম। পরবর্তীকালে তিনি বাদশাহ আলাউদ্দিন খিলজির সভাগায়ক, ধর্মগুরু এবং প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন।
মুসলমান ঐতিহাসিকদের মতে, হযরত আমির খসরু ৯৯টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। যার মধ্যে ‘নসিপীন’, ‘তুঘলকনামা’, ‘মহদফতরে মুসিকি আলম’ নামে কয়েকটি গ্রন্থ পাওয়া যায়। বাল্যকাল থেকেই সংগীত ও কবিতার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল প্রবল, পরিণত বয়সে যার চরমতম বিকাশ ঘটে। তৎকালীন হিন্দি ও ফারসি কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত। উর্দু ভাষার স্রষ্টা এবং আদি লেখক হিসেবেও তাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। প্রচলিত ব্রজভাষাকে তিনি সাহিত্যের ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন, যা আজো অনুসৃত হয়ে চলেছে। হযরত আমির খসরু হিন্দু সভ্যতার সমঝদার এবং হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁর রচনাবলিতে তিনি বহু হিন্দি শব্দের ব্যবহার করেন।
হযরত আমির খসরু [ Hazrat Amir Khusro ] পারস্যের (বর্তমান ইরান) সংগীতের মিশ্রণে তিনি ভারতীয় সংগীতে নিত্যনতুন রাগ সৃষ্টি করেছিলেন। ভারতীয় রাগ-রাগিণীকে তিনি ১২টি মোকামে বর্গীকরণ এবং বহু নতুন গীতরীতির প্রবর্তন করেন। এছাড়া নানা প্রকৃতির রাগ, তাল এবং বাদ্যযন্ত্রও উদ্ভাবন করেন। তাঁর সৃষ্ট গীতগুলোর মধ্যে কাওয়ালি, খামসা, খেয়াল, গজল, তারানা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। রাগসমূহের মধ্যে – ইমন, কাফি, জিলফ, পুরিয়া, পূরবী, বরারী, নিগার, সরফর্দা, সাজগির, সুনম বা সোনম, সোহানা ইত্যাদি বেশ সমাদৃত। আবার তালসমূহের মধ্যে আড়ঠেকা, কৈদ, জনানি, জাবেদ, ঝুমরা, দস্তান, পশতু, ফরদোস্ত, যৎ, সওয়ারি, মুলতান বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো।
বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের আবিষ্কার ও উন্নতি সাধনে হযরত আমির খসরু আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছেন। সেতার, ঢোল, তবলা-বাঁয়া প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের আবিষ্কারক হিসেবে সংগীত ইতিহাসে হয়ে আছেন তিনি কিংবদন্তি। অবশ্য এগুলো হযরত আমির খসরু [ Hazrat Amir Khusro ] আবিষ্কৃত কি না সে বিষয়ে নানারকম মতভেদ রয়েছে। কেননা এগুলোর অধিকাংশই প্রাচীন ভারতে অন্য নামে বিদ্যমান ছিল বলে অনেক সংগীত-গবেষক ও গুণীজন মনে করেন। তবে তিনি যে নানাভাবে সংগীতের উন্নতি সাধন করেছিলেন সে-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
সংগীতস্রষ্টা হিসেবে সংগীতজ্ঞ হযরত আমির খসরুর অবদান সম্পর্কে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় যে, তিনি ভারতীয় সংগীতে পারস্য উপাদান যুক্ত করে প্রথমত একটি নতুন পদ্ধতির সূচনা করেন। পরবর্তীকালে যা ‘হিন্দুস্তানি বা উত্তর ভারতীয় সংগীত পদ্ধতি’ নামে ইতিহাসে স্থান পায়। একসময় দক্ষিণ ভারতীয় কিছু অঞ্চল ছাড়া সমগ্র ভারতেই এ পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়ে।
![হযরত আমির খসরু [ Hazrat Amir Khusro ] 2 YaifwwriN4BzRFCyqbslL4 হযরত আমির খসরু [ Hazrat Amir Khusro ]](https://sp-ao.shortpixel.ai/client/to_auto,q_glossy,ret_img,w_160,h_120/https://bn.musicgoln.com/wp-content/uploads/1965/12/YaifwwriN4BzRFCyqbslL4-300x225.png)
হযরত আমির খসরু [ Hazrat Amir Khusro ] আবির্ভাবের পূর্ব থেকেই অবিমিশ্র সুরকলা হিসেবে আলপ্তি বা আলাপ ধারার প্রচলন ছিল। এতে কোনো তাল ও বন্দিশ ছিল না। এই ধারার অবিমিশ্র রূপটি ঠিক রেখে তিনি স্থায়ী এবং অন্তরা এই দুটি তুক ও তাল যুক্ত করে নতুন এক সংগীতধারা সৃষ্টি করেন। অবিমিশ্র সুরকলার এই নবধারার নাম ‘তারানা’ বা ‘তেলেনা’। আলপ্তির ‘রি রে নোম’ এই বোলগুলির জায়গায় তিনি তারানার বন্দিশে ‘না দির তা না দিম্’ প্রভৃতি বোল ব্যবহার করেন।
অবিমিশ্র সুরকলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শনরূপে এই ধারাটি অদ্যাবধি সুপ্রচলিত রয়েছে। সংগীতজ্ঞ হযরত আমির খসরুর তারানা সৃষ্টি সংগীতের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। ইতিহাসের ক্রমধারায় দেখা যায় আমির খসরুর প্রায় দুইশত বছর পর গোয়ালিয়রের রাজা মানসিংহ তোমরের (১৪৮৬-১৫১৬ রাজত্বকাল) রাজদরবারে ব্যাপকভাবে ধ্রুপদ সংস্কারের কাজ সম্পন্ন হয়।
ধ্রুপদের বাট, লয়কারী, তেহাই বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, এইসব সুরকর্মের সঙ্গে তারানাশৈলীর সাদৃশ্য বিদ্যমান। এ থেকে ধারণা করা যায় যে, প্রবন্ধগান থেকে ধ্রুপদকে অবিমিশ্র সুরকলায় রূপান্তরকরণের ক্ষেত্রেও হযরত আমির খসরুর সৃষ্টি থেকে উপাদান চয়ন করা হয়েছে।
সংগীতজ্ঞ হযরত আমির খসরুর আধ্যাত্মিক গুরু দরবেশ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার মৃত্যু হয় ১৩২৪ খ্রিষ্টাব্দে। এই মৃত্যু তাঁকে অত্যন্ত বিচলিত করে তোলে এবং সে বছর তাঁরও মৃত্যু হয়। ঋদ্ধ সংগীতজ্ঞ আমির খসরুর ইচ্ছানুসারে গুরুজির সমাধির দক্ষিণ বরাবর তাঁকে কবর দেওয়া হয়। দিল্লিতে এই সমাধিস্থলে প্রতিবছর বহু সংগীতজ্ঞের সমাগম হয়ে থাকে এবং তাঁর রচিত গান গেয়ে স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
হযরত আমির খসরু [ Hazrat Amir Khusro ] র তিন পুত্রের মধ্যে ফিরোজ খাঁ সেতারশিল্পী হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেন। তবে বর্তমানে তাঁর বংশধরেরা তবলাশিল্পী হিসেবেই বেশি প্রসিদ্ধ।