বাণীকুমার (বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য ) । বাঙালি বেতার সম্প্রচারক, গীতিকার, প্রযোজক ও নাট্য পরিচালক

বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য যিনি বাণীকুমার নামেই পরিচিত, ছিলেন একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি বেতার সম্প্রচারক, গীতিকার, প্রযোজক ও নাট্য পরিচালক। তিনি কলকাতার বাসিন্দা ছিলেন। পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সমসাময়িক বাণীকুমার ১৯৩০-এর দশক থেকে সুদীর্ঘকাল অল ইন্ডিয়া রেডিওয় বেতারকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

তার সর্বাধিক পরিচিতি তাঁর মহিষাসুরমর্দিনী নামক বেতার সঙ্গীতালেখ্যটির রচনা ও প্রবর্তনার জন্য। ১৯৩১ সাল থেকে অদ্যাবধি মহালয়ার দিন ভোর চারটের সময় কলকাতার আকাশবাণী থেকে এই অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হয়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এই অনুষ্ঠানের ভাষ্য ও শ্লোকপাঠ করেছেন।

জন্ম ও বাল্যকাল

তার পিতৃদত্ত নাম বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য। তিনি ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ নভেম্বর হাওড়ার কানপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ও ইতিহাসবিদ বিধুভূষণ ভট্টাচার্য এবং মা অপর্ণা ভট্টাচার্য। তাঁদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন তিনি। তাঁদের আদি নিবাস ছিল হুগলির আঁটপুরে।

শিক্ষাজীবন

তিনি হাওড়া জেলা বিদ্যালয়ে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ করেন। সেখানে শিক্ষক তথা কবি করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগ্রহে কাবিরচনায় তিনি মনোনিবেশ করেন। এরপর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি ইংরেজিতে স্নাতক হন। তাঁর পিতা ও পিতামহের সংস্কৃতে জ্ঞান থাকায় তিনিও সংস্কৃত বিষয়ে পড়াশোনা করেন এবং ‘কাব্যসরস্বতী’ উপাধি পান।

কর্মজীবন

সাংসারিক চাপে পড়াশোনা বেশিদূর না করতে পারায় তিনি টাঁকশালে চাকরি করা শুরু করেন। স্মৃষ্টিশীল মননের অধিকারী হওয়ায় ১৯২৭খ্রিস্টাব্দে ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসে এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে কলকাতা বেতারকেন্দ্র স্থাপিত হলে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে বেতারকেন্দ্রে যোগ দেন। তৎকালীন সময়ে বেতারকেন্দ্রের ভারতীয় অনুষ্ঠান বিভাগের অধিকর্তা নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদারের আগ্রহে বেতারকেন্দ্র যোগদান করেন রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজকুমার মল্লিক, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র প্রমুখ শিল্পী। সেখানেই রাইটার স্টাফ আর্টিস্ট হয়ে বৈদ্যনাথ কাজে যোগদান করেন এবং ‘বাণীকুমার’ নামে তাঁর বেতার জীবন শুরু করেন।

মহিষাসুরমর্দিনী বেতার অনুষ্ঠানের রচয়িতা হিসেবে তিনি সর্বাধিক পরিচিত। তাঁর রচিত কবিতা গুলি হল চিত্রলেখা, বিদুষী, জাগৃহী, মরু-মায়া ইত্যাদি। এছাড়াও রাজপুত্রনাটকে এবং ‘ভাগ্যচক্র’, ‘দেনা-পাওনা’, ‘রূপলেখা’ ও ‘দেবদাস’ ছবিতে তার রচিত গান গাওয়া হয়েছে। তিনি বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য – ‘সন্তান’, ‘সপ্তর্ষি’, ‘গীতবল্লকী’, ‘কথা-কথালি’, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’, ‘রায়বাঘিনী’, ‘হাওড়া হুগলীর ইতিহাস’, ‘স্বরলিপিকা’ (২ খন্ড) ইত্যাদি। তিনি ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে কাজী নজরুল ইসলামের ‘ওমর খৈয়াম’-এর বেতার নাট্যরূপ রচনা করেছিলেন।

বাণীকুমারের জীবনের নানা অজানা নানা কথা জানালেন জ্যোষ্ঠ পুত্র নৃশিংহ কুমার ভট্টাচার্য

১৯৩৪-এর ৮ ই অক্টোবর। মানে, ১৩৪১ বঙ্গাব্দ। মহালয়ার সকাল ছ’টা থেকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত প্রচারিত হয় ঐতিহাসিক এক অনুষ্ঠান। গ্রন্থনা ও চণ্ডীপাঠে ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। ধর্মকে যারা চিরদিন বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রাখতে চায়, সেই রক্ষণশীল দলের পক্ষ থেকে এটি ঘিরে তীব্র আপত্তি ওঠে। প্রতিবাদের মূল কারণ ছিল– এক অব্রাহ্মণ ব্যক্তির কন্ঠে কেন চণ্ডীপাঠ শোনা যাবে? অনুষ্ঠানের রচনা ও প্রবর্তনায় ছিলেন তিনি। তিনি রুখে দাঁড়িয়ে বললেন, বীরেন্দ্রকৃষ্ণই করবেন গ্রন্থনা ও চণ্ডীপাঠ। সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তিনি। আর, তার পরেই তৈরি হল একটা ইতিহাস।

বাণীকুমারের আসল নাম বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য। সোমবার তাঁর জীবনের নানা অধ্যায়ের আপাত অজানা নানা কথা জানালেন জ্যোষ্ঠ পুত্র নৃশিংহ কুমার ভট্টাচার্য| এখন বয়স ৭৯| বললেন, “আমি তিন ভাইয়ের মধ্যে বড়| তবে, আমার দুই দিদি আছে| ওদের নাম অরুনলেখা ও সোমলেখা| এই নামদুটো ভীষনভাবে বিরল| মহিষাসুরমর্দিনী’র সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত পঙ্কজকুমার মল্লিকও| তিনি আমার বাবাকে বলে বড় দিদির নামে নিজের মেয়ের নাম রেখেছিলেন|”

তার জন্ম হাওড়ায় মাতুলালয়ে| জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে বাগবাজারে| উত্তর কলকাতার সেই বাড়ি ভেঙ্গে ফ্ল্যাট হয়েছে| নৃশিংহবাবু প্রায় দেড় যুগ আগে চলে এসেছেন কেষ্টপুরে| এক তলায় বসার ঘরে বাবার, অর্থাৎ বাণীকুমারের কাঠের বড় টেবিল, চেয়ার, আলমারি, প্রচুর বই আর বাবার স্মৃতি|

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত মনোবিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক নৃশিংহবাবু বলেন, “এখনও আমি বইয়ে ডুবে থাকি| বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই|” ৫০ বছর আগে তিনি ট্রামে চড়ে শ্যামবাজার থেকে বাগবাজারে যেতেন। তাঁর মাসিক টিকিটে মূল নামটা অর্থাৎ বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য লেখা। সেই টিকিট দেখলাম নৃশিংহবাবুর কাছে। সঙ্গে সেকালের কিছু চিঠি, বাণীবাবুর পকেটঘড়ি, হাতঘড়ি, হরেক রকম কলম, পানদানি, জর্দাদানি, চশমা, বাঁধানো দাঁত, কাঠের চিরুনি প্রভৃতি| পুরনো পয়সার ঝুলিতে প্রচুর ব্রিটিশ আমলের মুদ্রা।

মহিষাসুরমর্দিনী’র সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বাণীকুমার। অনেকের ধারণা। প্রথম দু’জনের তুলনায় একটু হয়তো আড়ালেই থেকে গেছেন তিনি। অথচ মূল অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনা ও রচনা বাণীকুমারেরই| এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে অবশ্য বলেন, “এ রকম তুলনার অর্থ নেই| বাণীকুমার বাণীকুমারই| বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে ওরা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছেন|”

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার ধ্যানের ধন। কবিগুরুর বহু কবিতার নাট্যরূপ দান করেছেন তিনি । তার সঙ্গে কবি নজরুলেরও হৃদ্যতা জন্মেছিল। এ সব বিস্তারিত জানিয়ে বলেন, আকাশবানীর প্রায় গোড়া থেকে যুক্ত ছিলেন বাণীকুমার। তাঁর সৃজনশীলতা কেবলমাত্র বেতারের জন্য নাটক রচনা ও প্রচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নি।

তাঁর বহু প্রবন্ধ ও গল্প বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত হয়েছে। কোন পরিস্থিতিতে, কীভাবে তিনি পরিচিত হলেন বাণীকুমার হিসাবে- আলোচনা করলেন তা নিয়ে | কেন্দ্রীয় ডাকবিভাগের অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক দেবাশিস সুর এই প্রতিবেদককে বলেন, “১৯৬৫ অর্থাৎ ক্লাশ টু থেকেই আমি শৈলেন্দ্ৰ সরকার স্কুলের ছাত্র ছিলাম। আমার খুব মনে পড়ে ওনার বাড়ির কথা। বাড়িটা তখন খুব ভালো রং করা ছিল না।

তেলিপাড়া দিয়ে যাওয়ার পথে ওই বাড়ি। উনি থাকতেন ১৯৯১ পর্যন্ত। স্কুল জীবনে বহুবার দেখেছি ওনাকে। তখন কিন্তু সেই রকম কোনও প্রচার ছিল না। পরে ওখানে ওনার একটি মূর্তি স্থাপন হয়।“ এই প্রসঙ্গে নৃশিংহবাবু বলেন, “হ্যা| স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা আমাকেও থাকার অনুরোধ করেছিলেন| ছিলামও| জন্মস্থান বলে হাওড়াতেও একটা মূর্তির আবরণ উন্মোচন হয়েছে|”

Leave a Comment