কিশোর কুমার । ভারতীয় গায়ক, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং রেকর্ড প্রযোজক

কিশোর কুমার ছিলেন ভারতীয় গায়ক, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং রেকর্ড প্রযোজক।সাধারণত তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের সর্বাধিক সফল এবং চলচ্চিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ নেপথ্য গায়ক হিসেবে বিবেচিত হন। কিশোর কুমারের চার অদ্ভুত কাহিনী:-কিশোর কুমার ৪ই আগস্ট ৪টার সময় জন্ম গ্রহণ করেন এবং ৪র্থ সন্তান। তিনি জীবনে ৪ টি বিয়ে করেন, চলচ্চিত্র জীবনে ৪টি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

কিশোর কুমার । ভারতীয় গায়ক, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং রেকর্ড প্রযোজক

প্রাথমিক জীবন

কিশোর কুমার মধ্যপ্রদেশের খান্ডোবাতে বাঙালি গাঙ্গুলী (গঙ্গোপাধ্যায়) পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা কুঞ্জলাল গাঙ্গুলী ছিলেন একজন উকিল। কুঞ্জলাল গাঙ্গুলীর পৈতৃক বাড়ি ও জন্মস্থান হলো ঢাকার অদূরে বিক্রমপুরে (বর্তমান নাম মুন্সীগঞ্জ) তার মার নাম ছিল গৌরী দেবী। কুঞ্জলাল জীবিকার তাগিদে মধ্য প্রদেশে চলে যান। কিশোর কুমারের জন্মনাম ছিল আভাস কুমার গাঙ্গুলী। চার ভাই বোনের ভিতর কিশোর ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। সবথেকে বড় ছিলেন অশোক কুমার তারপর সীতা দেবী। তারপর অনুপ কুমার আর অনুপ কুমারের থেকে পাঁচ বছরের ছোট ছিলেন কিশোর কুমার।

কিশোরের শৈশব

কিশোরের শৈশবকালীন সময়েই তার বড়দা অর্থাৎ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অশোক কুমার বোম্বেতে হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে বড় সাফল্য পান। এই সফলতা ছোট্ট কিশোরের উপরে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। ছোটবেলা থেকেই কিশোর বিখ্যাত গায়ক কুন্দন লাল সায়গলের একজন বড় ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি সায়গলের গানগুলো অনুকরণ করতেন বা নকল করে গাইতেন। এছাড়াও তার বাড়ির লোক তাকে দাদা অশোক কুমারের বিখ্যাত গান “মেঁ বন কে পঞ্ছী বন বন কে” বার বার গাইতে বলতেন। অশোক কুমারের সাফল্যের পর কিশোরের আরেক দাদা অনুপ কুমারও বোম্বের হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন।

কিশোর কুমার । ভারতীয় গায়ক, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং রেকর্ড প্রযোজক

ষাটের দশকের পথ চলা

এই সময়কালে কিশোর কুমারের বেশকিছু চলচ্চিত্র ব্যবসায়িকভাবে অসফল হয়ে পড়ে, এই সময় তিনি পাকাপাকিভাবে গানের জগতে নিজেকে যুক্ত করে ফেলেন মনে রাখার মত। মুনিমজি (১৯৬২), গাইড (১৯৬৫) এবং জুয়েল থিফ (১৯৬৭) চলচ্চিত্রতিনটিতে তার গাওয়া গান তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়।

১৯৬৬ সালে সুরকার হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটে শচীন দেব বর্মনের পুত্র রাহুল দেব বর্মণের। তার প্রথম দর্শকপ্রিয়-ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র তিসরি মঞ্জিলে কিশোর কোন গান গাননি। কিন্তু ১৯৬৮ সালে ‘পড়োশন’ চলচ্চিত্রে রাহুল দেব বর্মণের সুরে কিশোর বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গান গান।

সঙ্গীত জীবন

পরবর্তী বছরগুলোতে কিশোর গায়ক হিসাবে ব্যাপক সাফল্যতা লাভ করেন। সে সময়ে বলিউডে প্রতিষ্ঠিত সব নায়ক যেমন রাজেশ খান্না, শশী কাপুর, ধর্মেন্দ্র, রণধীর কাপুর, সঞ্জীব কুমার এবং দেব আনন্দের জন্য তিনি গান গেয়েছেন। এই সময়ে শচীন দেব বর্মণ এবং রাহুল দেব বর্মণের সুরে তিনি প্রচুর কালজয়ী গান গেয়েছেন। রাহুল দেব বর্মনের সুরে তিনি বোম্বে টু গোয়া চলচ্চিত্রতে প্রথমবারের জন্য অমিতাভ বচ্চনের জন্য গান করেন। ১৯৭৩ সালে অমিতাভের ‘অভিমান’ চলচ্চিত্রের জন্য তার গানগুলি জনপ্রিয় হয়। এরফলে পরবর্তী মেগাস্টার অমিতাভের নেপথ্য গায়ক হিসাবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

কিশোরের এই সাফল্যের পরে বলিউডের অন্য সুরকারেরাও তাকে নিজেদের প্রধান গায়ক হিসাবে বেছে নিতে বাধ্য করে। এঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারেলাল জুটি। গীতিকার আনন্দ বক্সী সুরকার লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারেলাল এবং কিশোরকুমার জুটি বেশ কিছু রাজেশ খান্নার চলচ্চিত্রের জন্য অনবদ্য সঙ্গীত উপহার দেন। যেমন দাগ, রোটি, হাথি মেরে সাথি। লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারেলালের সুরেই কিশোর ও মোহাম্মদ রফি একসাথে গান করেন এবং কিশোর ও লতা মঙ্গেশকরের বেশ কিছু ভাল দ্বৈত গান তৈরি হয়।

কিশোর কুমার বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় গান গেয়েছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে বাংলা, হিন্দি, মারাঠি, অসমীয়া, গুজরাটি, কন্নড়, ভোজপুরি, মালয়ালম, ওড়িয়া, এবং উর্দু। এছাড়াও তিনি তার ব্যক্তিগত গান সংকলনেও বিভিন্ন ভাষায় গান গেয়েছেন, বিশেষত তার বাংলায় গাওয়া গানগুলি সর্বকালের ধ্রুপদী গান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তিনি ৮ বার শ্রেষ্ঠ পুরুষ নেপথ্য গায়কের জন্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জিতেছেন এবং একই বিভাগে সর্বাধিক ফিল্মফেয়ার পুরস্কার বিজয়ের রেকর্ড করেছেন। তাকে মধ্যপ্রদেশ সরকার কর্তৃক লতা মঙ্গেশকর পুরস্কার প্রদান করা হয় এবং তার নামে হিন্দি চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য কিশোর কুমার পুরস্কার প্রদান চালু করে।

 

YaifwwriN4BzRFCyqbslL4 কিশোর কুমার । ভারতীয় গায়ক, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং রেকর্ড প্রযোজক
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

সাধারণত গায়ক হিসাবে তাকে দেখা হলেও তিনি হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের একজন গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতাও ছিলেন। তার অভিনীত বিখ্যাত কয়েকটি হাস্যরসাত্মক চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে বাপ রে বাপ (১৯৫৫), চলতি কা নাম গাড়ি (১৯৫৮), হাফ টিকিট (১৯৬২), পড়োশন (১৯৬৮), হাঙ্গামা (১৯৭১), পেয়ার দিবানা (১৯৭৩), বাড়তি কা নাম দাড়ি (১৯৭৪)। এছাড়া অন্যান্য চলচ্চিত্রের ভিতর রয়েছে নোকরি, বন্দী, দূর গগন কি ছাঁও মে, দূর কা রাহি প্রভৃতি।

কিশোর কুমার । ভারতীয় গায়ক, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং রেকর্ড প্রযোজক

বাংলা গান এবং চলচ্চিত্র

হিন্দির পাশাপাশি তিনি প্রচুর জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্র সহ বাংলা আধুনিক গানও গেয়েছেন। উত্তম কুমারের জন্য তার প্লেব্যাক করা উল্লেখযোগ্য ছবির ভিতর রয়েছে রাজকুমারী, অমানুষ, আনন্দ আশ্রম এবং ওগো বধূ সুন্দরী। একটি বাংলা ছবি লুকোচুরি তে তিনি নায়কের অভিনয় এবং গান করেছেন। সত্যজিৎ রায়ের দু’টি চলচ্চিত্র চারুলতাএবং ঘরে বাইরের জন্য তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছিলেন।

বাংলা চলচ্চিত্রের বিখ্যাত দুই নায়ক প্রসেনজিৎ এবং তাপস পালের কেরিয়ারের দুই উল্লেখযোগ্য হিট যথাক্রমে অমর সঙ্গী এবং গুরুদক্ষিণার জন্যও তিনি প্লেব্যাক করেছিলেন। কেরিয়ারের শেষদিকে কিশোর কুমার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অ্যালবাম রেকর্ড করেন। কিশোর কাজের সূত্রে বম্বেতে থাকলেও তিনি ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি। শোনা যায়, তিনি নাকি বাঙালি খাবার খেতে বেশী পছন্দ করতেন।

প্রত্যেক পুজোতে তিনি অ্যালবাম প্রকাশ করতেন। বিশেষত তার এই পুজো অ্যালবামের গানগুলো বাংলায় অন্যতম সুপারহিট বলে পরিগণিত হয়। তার এই গানগুলো এখনও পর্যন্ত ততটাই জনপ্রিয় আছে। এখনও এই গানগুলো বিভিন্ন পুজো প্যান্ডেলে না বাজলে মনে হয়না দুর্গাপূজা এসেগেছে। কিশোর কুমারের গান বাংলা সঙ্গীতজগতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাঙালির সংষ্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতাবে জড়িয়ে রয়েছেন কিশোর কুমার। তার উদাত্ত কণ্ঠ মাধুর্য্য বাঙালিকে এখনও মুগ্ধ করে রেখেছে।

ব্যক্তিগত জীবন

কিশোর কুমার চারবার বিয়ে করেছেন। রুমা গুহঠাকুরতা (১৯৫০-১৯৫৮), মধুবালা (১৯৬০-১৯৬৯), যোগিতা বালী (১৯৭৫-১৯৭৮) এবং লীনা চন্দাভারকর (১৯৮০-১৯৮৭)। কিশোরের প্রথম পুত্র (রুমা গুহ ঠাকুরতার সাথে) অমিত কুমার একজন বিখ্যাত গায়ক। যোগিতা বালিকে পরে মিঠুন চক্রবর্তী বিবাহ করেন। কিশোর কুমারের প্রথম স্ত্রী রুমা গুহ ঠাকুরতা এবং কিশোর কুমারের সুযোগ্য সন্তান অমিত কুমার তার বাবার মত সাফল্য না পেলেও বেশ কিছু কালজয়ী হিন্দি ও বাংলা সুপারহিট গান উপহার দিয়েছেন। কিশোরের ছোট ছেলে সুমিত কুমার (লীনা চন্দাভারকরের সাথে) একজন গায়ক হবার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

কিশোর কুমার । ভারতীয় গায়ক, গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং রেকর্ড প্রযোজক

 

মৃত্যু

অক্টোবর ১৩, ১৯৮৭ সালে ৫৮ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ভারতের এই জনপ্রিয় শিল্পীর মৃত্যু ঘটে।

প্রভাব

হিন্দি চলচ্চিত্রের সঙ্গীতের উপর তার প্রভাব এখনও বিশাল ও ব্যাপক। বর্তমান কালের প্রতিষ্ঠিত অনেক গায়ক যেমন কুমার শানু, অভিজিৎ, বাবুল সুপ্রিয়, অমিত কুমার প্রায় সকলেই তাদের কেরিয়ারের প্রথম দিকে কিশোরের গানগুলোক অনুকরণ বা নকল করে গাইতেন। তার গানের এখনও খুব ভাল বাজার। তার গানের পুনঃনির্মাণ এবং পুনঃমিশ্রণ বাজারে প্রচুর বিক্রি হয়। তার গাওয়া গানগুলো এখনও সঙ্গীতপ্রেমী মানুষদের কাছে অনুপ্রেরণা। এখনও অনেক শিল্পী তার গাওয়া গানগুলোকে নকল করার চেষ্টা করে। হিন্দি ও বাংলা ভাষার গানে তিনি নতুন এক যুগের সূচনা করেন। সর্বোপরি এখনও পর্যন্ত হিন্দি ও বাংলা ভাষার সঙ্গীতজগতে তার প্রভাব ব্যাপক।

পরিসংখ্যান

কিশোর কুমার সর্বমোট ২,৭০৩টি গান গেয়েছেন, যার মধ্যে ১১৮৮টি হিন্দি চলচ্চিত্রে, ১৫৬টি বাংলা এবং ৮টি তেলুগু ভাষায়।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment